সুইসাইড
রবিন জামান খান
দৌড়াতে দৌড়াতে মি. হাসান রেললাইনের পাশে বেঞ্চটার কাছে এসে থেমে গেলেন। জোরে জোরে বাতাস টেনে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। প্রতিদিনের মতো আজও জগিং করতে করতে একদম বেঞ্চটার কাছে এসে থামলেন। খুব বিশালদেহী না হলেও চমৎকার ফিট বডি তার। আর প্রতিদিন সকালে জগিং করাটা এখন তার কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে শান্ত পরিবেশে জগিং করাটা উনি খুবই উপভোগ করছেন। প্রায় মাসখানেক হলো এখানে বেড়াতে এসেছেন। এলাকাটা খুবই চমৎকার। শান্ত, কোলাহল নেই। ঠিক যেমনটা উনি চেয়েছিলেন। প্রেস, মিডিয়া পলিটিক্যাল লোকজনের ক্যাচক্যাচানি নেই। বডিগার্ডরা আছে তবে উনি জগিঙের সময় ওদেরকে আসতে মানা করেন। তাই ছুটিটা ভালো লাগছে। তবে এটাকে কতোটা ছুটি বলা যায় সেটাও একটা ব্যাপার। আসলে উনি এই নির্জন পরিবেশে এসেছেন চুপচাপ কিছু জরুরি কাজ সারতে। আগামী মাসে তার খুবই জরুরী আন্তর্জাতিক একটা মিটিং আছে। সেখানে এমন কিছু জটিল বিষয় পেশ করতে যাচ্ছেন যাতে অনেকেরই মাথা খারাপ হবে। কাজেই প্রস্তুতিটাও সেভাবেই নিতে হবে।
প্রতিদিনের মতোই বেঞ্চটার কাছে এসে থেমে গেলেন। এখানে কিছুক্ষন বিরতি দিয়ে আবার ব্যাক করবেন। কিন্তু আজ বেঞ্চটাতে এক যুবককে বসে থাকতে দেখে অবাক হলেন খানিকটা। বেঞ্চের একপাশে বহে ক্যান থেকে পানি খেতে খেতে যুবককে খেয়াল করলেন। বয়স খুব বেশি, না পচিশ ছাব্বিশ হবে। একটু লম্বা এলামেলো চুল, বেশ ফর্সা সুদর্শন চেহারা। যদিও বেশ মলিন। খানিক উদাস ভঙ্গিতে বসে আছে।
ব্যাপার কি? হাসান সাহেব মনে মনে ভাবলেন। এই এলাকায় তো কেউ বেড়াতে আসে না। আর এই ছেলেটাকে লোকাল বলেও মনে হচ্ছে না। এতো সকালবেলা এখানে কি করছে? হঠাৎ দেখলেন যুবক পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে পড়ছে। পড়তে পড়তে তার চোখ বেয়ে পানি গড়াতে লাগলো।
ছেলেটা কাঁদছে! “এক্সকিউজ মি? আপনি ঠিক আছেন? কোন সমস্যা?
চোখ তুলে তাকালো সে। গভীর বিষাদময় দৃষ্টি। কিছু না বলে অন্যদিকে ফিরে তাকালো।
মি. হাসান একটু বিব্রত বোধ করলেন। উঠে যাবেন কিনা ভাবছেন এমন সময় ছেলেটা বললো, “একটু পানি খাওয়া যাবে?”
“কি?” ছেলেটার ভাঙা গলার কারনে হাসান সাহেব কথাটা বুঝতে পারেন নি।
ছেলেটা পানির ক্যানের দিকে দেখালো। “পানি।”
“হ্যা, শিওর।”
ছেলেটা পানি খাচ্ছে হাসান সাহেব জানতে চাইলেন, “একটা কথা জানতে পারি, আমি এখানে প্রায় মাসখানেক যাবৎ আছি আপনাকে তো এদিকে দেখিনি। তাও এইরকম সকালবেলা।”
“আমি এখানে থাকি না।”
“ও, তা একটু আগে দেখলাম কাঁদছেন। কি ব্যাপার? কোন সমস্যা? আমাকে বলতে পারেন।”
“আপনি কে?”
“ও আমি হাসান।”
“ইরাজ।”
“নাইস টু মিট ইউ,” বলে হাসান সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলেন।
ছেলেটা হাতটা না ধরে উদাস সুরে জানতে চাইলো, “এখান দিয়ে ট্রেন যাবে কখন বলতে পারেন?”
“সঠিক তো জানিনা। তবে আমি জগিং করে ফেরার সময়ে একটা ট্রেন পাস করতে দেখি প্রতিদিন। কেন, আপনি কোথাও যাবেন নাকি?
“হ্যা।”
“কিন্তু ট্রেন তো এখানে থামেনা।”
“আমার তো থামার দরকার নেই।”
“ট্রেন না থামলে যাবেন কিভাবে?
“কিছু কিছু জায়গা আছে যেখানে যেতে হলে চলন্ত ট্রেন দরকার।”
“মানে, কোথায় যাবেন আপনি?
“আমি সুইসাইড করবো।”
“কি? আপনার মাথা ঠিক আছে তো?
ছেলেটা উত্তর না দিয়ে সামনে তাকিয়ে রইলো। মুখে দুঃখের হাসি। “ঠিক আছে দেখেই তো মরতে চাই।”
“তাই, কী এমন হয়েছে যে আপনাকে মরতে হবে।”
“আমি একজন খুনী।”
“আপনি খুনী?
“হ্যা।”
“আমি বিশ্বাস করিনা।”
“কেন?”
“খুনী কি কখনো নিজে বলে আমি খুনী?
“আমি কখনো মিথ্যে বলিনা। আপনি বিশ্বাস না করলে কি হবে আইন তো করে। আমার বাবা মা তো করে। সমাজের সবাই তো করে। আর একারনেই তো আমাকে পালাতে হয়েছে।”
“তা, কাকে খুন করেছেন আপনি।”
“আমার সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ডকে।”
“দেখুন আমি আপনার কেউ না। তবে এটুকু বলতে পারি আপনার সমস্যা যাই হোক না কেন আমি তা সমাধান করার ক্ষমতা রাখি। আপনি আমাকে বলুন তো আসলে ব্যাপারটা কি?
“আমি আগ্রহী না। কারন আমার সমাধান করার কোন আগ্রহ নেই। আমি আর…
ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। ছেলেটা মুখ ফিরিয়ে একবার দেখলো। তারপর উঠে দাড়িয়ে হাসান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো। “আমি আসলেই আর বাঁচতে চাইনা। যার কেউ নেই, কিছু নেই, কোন গন্তব্য নেই তার বাঁচার কোন দরকারও নেই। তবে শেষ মুহূর্তে আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। আপনি আমাকে দেখে, পরিচিত হয়ে আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছেন। আর আমার কাছের কেউ গত কয়েকমাসে আমাকে এতোটুকু সাহায্য তো দূরে থাক বিশ্বাসও করেনি। থ্যাঙ্কস।”
ছেলেটা রেললাইনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হাসান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। উনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন ছেলেটাকে মরতে দিবেন না। দরকার হলে গায়ের জোর খাটিয়ে হলেও ফেরাবেন। উনি পেছন থেকে ইরাজের কাঁধে হাত রাখলেন। “দেখো ইরাজ, তুমি আমার ছেলের বয়সই হবে। সুইসাইড কোন সমাধান না। আমি একজন পওয়ারফুল মানুষ আমি তোমাকে হেল্প করতে পারবো।”
“সরি,” কাঁধ থেকে হাতটা নামিয়ে ছেলেটা সামনে এগোতে লাগলো। ট্রেনটো কাছাকাছি চলে এসেছে।
মি. হাসান ওর একটা হাত ধরে ফেললেন। “দেখো তুমি ভুল করছো। আমি চোখের সামনে এভাবে একজন মানুষকে মরতে দিতে পারি না। বলে উনি হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন। ট্রেনটা আরো কাছে চলে এসেছে।
“কি করছেন আপনি? ছাড়–ন, আমি মরি বাঁচি আপনার কি? ছাড়–ন।” বলে সে হাতটা ছাড়ানোর জন্যে ধস্তাধস্তি করতে লাগলো। ট্রেনটা প্রায় চলে এসেছে।
ছেলেটা ট্রেন লাইনের প্রায় উপরে চলে যাচ্ছে। আর ট্রেনটাও প্রায় চলে এসেছে। এভাবে আরেকটু টানাহেঁচড়া চললে উনারা দুজনেই এক্সিডেন্ট করবেন। এদিকে ট্রেন ড্রাইভার লাইনের কাছে মানুষ দেখে হুইসেল বাজাচ্ছে।
“আমি তোমাকে ছাড়বো না। ” বলে হাসান সাহেব জোরে একটা টান দিলেন।
“ঠিক আছে, বলে ছেলেটা একদম শান্ত হয়ে গেল। “কিন্তু আমাদের একজনকে তো মরতেই হবে।”
“কি?” ভ্যাবাচেকা খেয়ে উনি হাতটা একটু আলগা করে দিতেই ছেলেটা ডান হাত হ্যাঁচকা টানে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রচন্ড শক্তিতে হাসান সাহেবের সোলার প্লেক্সাসে একটা পাঞ্চ করলো। পরমুহূর্তে তার পোলো শার্টের কলার ধরে কোমরে একটা মোচড় দিয়ে হিপ থ্রো করলো। বিষ্ময় আর ব্যাথায় হতভম্ভ হাসান সাহেব উড়ে গিয়ে পড়লেন ট্রেন লাইনের উপরে, আর তীব্র গতির ট্রেনটা তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে চলে গেল।
সুদর্শন যুবক বেঞ্চটার কাছে ফিরে এসে হাসান সাহেবের পানির ক্যানটা তুলে নিয়ে একঢোক পানি খেল। তারপর ক্যানটা ছুড়ে ফেলে দিল একপাশে। হাতের ছাপের ভয় নেই, ফলস লেয়ার লাগানো আছে, একজন প্রফেশনাল কিলার হিসেবে এই ধরনের সতর্কতা তো নিতেই হয়। সে আরেকবার রেললাইনের দিকে ফিরে তাকালো। হাসান সাহেবের মৃত দেহটা দেখলো। তারপর পেছন ফিরে হাঁটতে লাগলো।
কিছুদূর এসে একটা ঝোপের ভেতর থেকে বের করলো তার ব্যাকপ্যাকটা। প্রথমেই মুখের উপর থেকে বয়স কমানোর মেকাপের আলগা আবরন টেনে খুলে নিল, গায়ের শার্টটা খুলে পরে নিল একটা লেদার জ্যাকেট। শার্ট আর মেকআপ ব্যাগে ভরে ওটা থেকে বের করলো সানগ্লাস আর মোবাইল। সানগ্লাস চোখে পরে মোবাইলে ডায়াল করলো একটা বিশেষ নম্বরে।
“হ্যা, কাজ হয়ে গেছে। একমাসের প্ল্যান বৃথা যায়নি। অ্যাম্বেসির ওই কুরিয়ার ছেলেটার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলোও খুব কাজে লেগেছে। ঠিক যেভাবে আপনি বলেছিলেন এক্সিডেন্টাল ডেথ। ডিল কমপ্লিট। তো কন্ট্রাকের বাকি টাকা আমার অ্যাকাউন্টে জমা করে দিবেন।”
ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নিয়ে সে হাইওয়ের দিকে হাটতে লাগলো, গাড়িটা হাইওয়ের পাশেই রাখা। তবে মি. হাসানকে সে মিথ্যে বলেনি। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে ঠিক ওই ধরনের একটা অবস্থায় পড়ে নির্দোষ হয়েও তাকে সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ডের খুনের দ্বায় মাথায় নিতে হয়। কেউ তার কথা বিশ্বাস করেনি। পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে সেদিনও সে একইভাবে একটা রেললাইনের পাশে বসেছিল, অপশান ছিল দুইটা। এক, সুইসাইড আর না হয় পেশাদার সন্ত্রাসী হওয়া। প্রথমটার চেয়ে তার কাছে দ্বিতীয়টাই ভালো মনে হয়। তারপর সময়ের সাথে সাথে হয়ে উঠে কন্ট্রাক্ট কিলার।
হাঁটতে হাঁটতে অতীত মনে পড়াতে তার মুখে ফুটে উঠলো একটা বাঁকা হাসি…তাতে সামান্য দুঃখ খানিকটা তাচ্ছিল্লো…