২৫শে মার্চ: গল্পের পেছনের গল্প
সময়টা ২০১৩ সাল, বেশ একটা বেকার সময় পার করছিলাম তখন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড মাস্টার্স প্রায় শেষ দিকে, ফলে টুকটাক ক্লাশের বাইরে বলতে গেলে সময়ও ছিল। সে-সময়টাতে বলতে গেলে প্রায় সারাদিন ক্যাম্পাসেই কাটাতাম। সকালের বাসে ক্লাশ করতে এসে বাসার ফিরতাম রাতের বেলা, সকালে হাকিম চত্ত্বরের নাস্তা দিয়ে দিন শুরু করে, দুপুরে কেএফসি (কাদের ফ্রায়েড চিকেন) এর নুডলস দিয়ে চালিয়ে সন্ধ্যেয় ছবির হাটের রুটি-ভাজি দিয়ে দিন শেষ হতো। সেই সময়টাতে আমরা বেশিরভাগ আড্ডা দিতাম ছবির হাট আর হাকিম চত্ত্বরে। আমাদের বাংলাদেশের লেখালেখির জগতে সেইসময়ে একটা স্টেরিওটাইপ ধারণা প্রচলিত ছিল যে আমাদের দেশে মৌলিক থ্রিলার উপন্যাস লেখা সম্ভব নয়। সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে গুটিকয় লেখক সেইসময়ে মৌলিক থ্রিলার লেখা শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু একটা ভাষায় সাহিত্যের একটা ধারাকে এককভাবে ডেভলপ করতে হলে আরো লেখক প্রয়োজন ছিল। সেইসময়ে ছবির হাটের আড্ডাতেই একদিন পরিকল্পনা করা হয় একটা থ্রিলার গল্প সংকলন বের করা হবে যেখানে বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত সব থ্রিলার লেখকদের পাশাপাশি বাংলাদেশি থ্রিলার লেখকদেরও গল্প থাকবে।
পরিকল্পনা তো হলো কিন্তু প্রশ্ন হলো মৌলিক থ্রিলার গল্প পাওয়া যাবে কোথায়। প্রথম যেসব গল্পের অনুবাদ করা হবে সেগুলোর একটা লিস্ট করে তৎকালীন বেশ কয়েকজনকে দেয়া হলো, সেইসাথে অনুরোধ করা হলো যাতে অন্তত একটা করে হলেও মৌলিক গল্প লেখার চেষ্টা করে লেখকেরা। যারা গল্প অনুবাদ করিছিলেন তাদের অনেকেরই বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত বা ফেসবুকে পোস্ট করা মৌলিক গল্প ছিল। মজার বিষয় হলো পুরো ব্যাপারটা আমি নিজে আয়োজন করলেও আমার নিজেরই কোন গল্প লেখা ছিল না। সবার সব লেখা কালেক্ট করতে করতে মাথায় থাকা বেশ কিছু আইডিয়া নিয়ে কাজ করছিলাম। এর ভেতরে একটা নাটকের জন্যে একটা বাইক অ্যাক্সিডেন্টের জন্যে একটা দৃশ্য লিখেছিলাম, সেটাকে স্ক্রিপ্ট থেকে বর্ণনামূলক ভঙ্গিতে লিখতে লিখতে আমার প্রথমে মৌলিক গল্প সুইসাইডের আইডিয়া আসে। বেশ অনেকদিন ধরে গল্পটা নিয়ে ভাবলেও লিখেছিলাম এক বসায়। গল্পটা প্রকাশিত হলে ব্যাপক প্রশংসার পাশাপাশি ওটা থেকে টিভি নাটকও নির্মিত হয়। এর ভেতরে আরো বেশ কিছু গল্প লেখা হয় এবং থ্রিলার গল্প সংকরন দ্বিতীয় ভাগও প্রকাশিত হয়। আমার দুটো গল্প হোমিসাইড ও কুইন অব হার্টসও দারুণ প্রশংসিত হয়। এরপরের ধাপে বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল নিজের মৌলিক উপন্যাস লিখতে শুরু করা।
আমার মনে আছে আমরা সেইসময়ে বেশ কয়েকজন একসাথে নিজেদের প্রথম মৌলিক লেখার পরিকল্পনা করছিলাম। এর ভেতরে কেউ হরর, কেউ সাইকোলজিক্যাল, আর আমি নিজে ইতিহাস নিয়ে লেখার পরিকল্পনা করছিলাম। ইতিহাস নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি প্রাথমিকভাবে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিলাম তার ভেতরে অন্যতম কয়েকটা হলো: ইতিহাসের ঠিক কোন অংশটা নিয়ে রিখবো সেটা ঠিক করতে পারছিলাম না। এরপর যখন ঠিক করলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখবো, সেটাকে কিভাবে গল্পে সাজাবো কোন অংশটা নির্দিষ্ট করবো এবং বর্তমানের সাথে কিভাবে মেলাবো ঠিক ধরতে পারছিলাম না। এর পেছনে অন্যতম একটা কারণ ছিল আমার সামনে কোন রেফারেন্স পয়েন্ট ছিল না। কারণ যে-প্যাটার্ণটাতে আমি লেখার পরিকল্পনা করছিলাম এই প্যাটার্নে বাংলায় এর আগে এভাবে কেউই লেখেনি। ফলে আমার একমাত্র করণীয় ছিল বইয়ের দুনিয়ায় ডুব দেয়া। যা পেলাম পড়া শুরু করলাম।
যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প, কাজেই মুক্তিযেুদ্ধের ওপরে যা পাচ্ছিলাম পড়তে শুরু করলাম। এর পাশাপাশিষ ঘুরে এলাম মুক্তিযুদ্ধজাদুঘর, দেখতে শুরু করলাম মুক্তিযুদ্ধের ওপরে সব সিনেমা, সব ডকুমেন্টারি, পুরনো পত্রিকার কাটিং। আর ইতিহাস নিয়ে রেখা থ্রিলাররের ভাঙন্ডার উজার করণ তো চলছিলই। যা যা পড়েছিলাম এর ভেতরে অন্যতম ছিল: দ্য এইট, ম্যাজিক সার্কেল, দ্য ফায়ার, দ্য শার্লোকিয়ান, পল সাসম্যানের সব লেখা, উইলবার স্মিথ, জেমস রোলিন্স, রেমন্ড খাওরি, ন্যান্সি বিলেও এর সব বই। মোটা কথায় যা পাচ্ছিলাম পড়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তখনো সেই অবভিয়াস প্রশ্নের উত্তর আমি পিইনি, ঠিক কোন অংশটাতে আমি গল্প ফোকাস করবো এবং সেটাকে কিভাবে ব্লেন্ড করবো বর্তমান আর অতীতের সাথে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে একদিন আড্ডা দিতে দিতে চায়ের টঙের এক মামা জানালো বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বয়স্ক গার্ড চাচা আছেন যিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং একাত্তরের শুরুর দিকে উনি ক্যাম্পাসে ছিলেন। উনি আমাকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিষয়ে হেল্প করতে পারেন। উনাকে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে হাজির হলাম তার নারায়নগঞ্জের বাড়িতে। অনেক গল্প হলো, জানালের ২৫শে মার্চ রাতে উনি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিলেন। শোনালেন এমন কিছু অভিজ্ঞতার কথা, যা নেই কোন বইতে, কেভাবে সেদিন রাতে জগন্নাথ হলে হত্যাকান্ড চালানো হয়েছিল, কিভাবে প্রাণ বাঁচাতে ছাত্ররা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, কিভাবে ট্যাঙ্ক দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল রমনর কালী মন্দির, ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তৎকালীন শহীদ মিনার, কিভাবে রোকেয়া হলে রেইড চালিয়ে মেয়েদের ধরার সময়ে এক মেয়ে আর্মির একজনের গ্রেনেড ছিনিয়ে নিয়ে তাদেরকেউ উড়িয়ে দিয়েছিল। তন্ময় হয়ে তিনচারদিন ধরে শুনলাম চাচার গল্প এবং ঠিক করলাম প্রথম বই লিখবো ২৫শে মার্চ নিয়েই। সেই চাচার বাড়ির উঠানে বসেই বইয়ের নাম ঠিক করেছিলাম ২৫শে মার্চ।
কিন্তু তখনো আরো একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাকি, কিভাবে অতীত আর বর্তমানের ভেতরে মেলবন্ধনটা হবে, আর কিভাবে অতীত থেকে গল্পটা টেনে এনে সাজাবো বর্তমানের সাথে। আবারো অতীতে ডুব দেয়ার চেষ্টা এবং বই অঅর ইতিহাসে অবগাহন। এমন সময়ে নাজির হোসেনের কিংবদন্তির ঢাকা বই থেকে দারুণ এক ইতিহাস জানতে পারলাম, সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে ইংরেজরা যখন লাল কেল্লা দখল করার জন্যে আক্রমণ করে সেইসময়ে স্থানীয় এক সুবাদারের স্ত্রী গুটিকয় সেনাকে নিয়ে পরীবিবির মাজারের ভেতরে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ইংরেজ বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছিলেন। গল্পটা আমাকে মুগ্ধ করে। ইংরেজরা লাল বাগ কেল্লা আক্রমণ করেছিল মহররম বা এরকম এক ছুটির দিরে পরের দিন, একেবারে অতর্কিতে যাতে সৈন্যরা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে না পারে। ঝাড়ে ঝাড়ে বলতে গেলে বিনা প্রতিরোধে হত্যা করেছিল তাদের, এমন সময়ে এক নারী এভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল ব্যাপাটা দারুণ। আবারো অনুধাবন করলাম ইতিহাসের অবতলে কত রত্ন লুকিয়ে থাকে। পুরো ব্যাপারটা পড়ে প্রিয় ছোটভাই মেহেদি, নোমান, আর বন্ধু ডনকে নিয়ে একদিন ঘুরে এলাম লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, বাবু বাজারে অবস্থিত বাহ্ম সমাজ উপসনালয় ও লাইব্রেরি। সেইদিনের সেই ট্রিপ থেকে এসেই পরিকল্পনা করে ফেললাম পুরো বইটার।
এরপর সেমিস্টার ব্রেকের সময়ে ধীরে ধীরে পুরো বইয়ের আউটলাইন সাজিয়ে অবশেষে লিখতে শুরু করলাম ২৫শে মার্চ। এরপরের যাত্রার অনেকটাই পাঠকদের জানা। তবে একটা অসম্পূর্ণতা আজো রয়ে গেছে। ২৫শে মার্চ লিখতে লিখতে এই বইটা এবং এর পরের বই নিয়ে একটা ট্রিলজির পরিকল্পনা করেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম ঢাকা ট্রিলজি। ২৫শে মার্চ, ঢাকা ১৮৫৭, ঢাকার ছায়া নামে তিনটা বই হবার কথা ছিল ট্রিলজিতে। ২৫শে মার্চ লেখার পর বাকি দুটো বই আর লেখা হয়ে ওঠেনি। বইটা নতুন করে নালন্দা থেকে প্রকাশিত হবার পর এবার ইচ্ছে আছে ধীরে ধীরে বাকিবইদুটো লিখে ফেলার। দেখা যাক, সময় কি জটিল হিসেব কষে রেখেছে এই পরিকল্পনায়।
বই কেনার লিঙ্ক: Click Here
২৫ শে মার্চ পড়ার আগে আমি বাংলাদেশের এ ধাঁচের কোন বই পড়িনি। ধন্যবাদ।