সপ্তরিপু

সপ্তরিপু: গল্পের পেছনের গল্প

অন্যধারা থেকে প্রকাশিত সপ্তরিপুর বর্তমান কভার

সপ্তরিপু সৃষ্টির গল্পের পেছনের গল্প শুরুর আগে একটু ‘হিস্টোরিক্যাল ফিকশন’ অথবা বাংলায় যে-জনরাকে বলা হয় ‘ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস’ সেটা নিয়ে একটু বলতে চাই। বর্তমান বিশ্বে ইতিহাস আশ্রিত থ্রিলার উপন্যাস খুবই জনপ্রিয় একটি জনরা। কিন্তু সে-হিসেবে বলতে গেলে আমাদের বাংলা সাহিত্যে এই জনরাটি একসময় উপেক্ষিতই ছিল বলা চলে। আমি নিজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম। তাই অনার্সে পড়ার সময়ে সাহিত্যের পাশাপাশি প্রচুর ইতিহাস পড়া হোত। প্রথমদিকে পাঠ্যবই হিসেবে পড়তাম, এরপরে পড়তাম ভালোলাগা থেকে। তখন তো আর জানতাম যে ভবিষ্যতে লেখালেখি করবো, কিন্তু ইতিহাসের আকর্ষণীয় সব বিষয় পড়তে গিয়ে বার-বার মনে হোত আমাদের নিজেদের ইতিহাসে এতো দুর্দান্ত সব উপাদান রয়েছে চাইলে এগুলো নিয়ে অনেক চমৎকার ফিকশন লেখা সম্ভব। সেই সুবাদেই যখন নিজের প্রথম উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করছিলাম অনেকটা আনমনেই বেশ কয়েকটা আইডিয়ার ভেতরে ‘২৫শে মার্চ’ এর আইডিয়াটা নিয়ে কাজ শুরু করি। তো যাই হোক, সপ্তরিপু শুরু করার গল্পটা বলি।

সপ্তরিপুর প্রথম কভার

সময়টা ২০১৬ সালের মাঝামাঝি। ওই সময়টাতে অনেকটা এক্সপেরিমেন্ট হিসেবেই পরপর বেশ কয়েকটা নভেলা লেখার পর নিজের পরবর্তি উপন্যাস ‘ব্ল্যাক বুদ্ধা’র আউটলাইনের কাজ করছিলাম। কিন্তু ব্ল্যাক বুদ্ধার আউটলাইনিঙে খুব সমস্যা হচ্ছিলো। কারণ ওটা লেখার জন্যে মৌর্য সাম্রাজ্যের ওপরে আমার কিছু কনটেন্ট প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু কিছুতেই সঠিক ঐতিহাসিক কনটেন্ট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যে-কারণে ব্ল্যাক বুদ্ধার আউটলাইনিঙের কাজ শুরু করেও থামিয়ে দিতে বাধ্য হয়ে কনটেন্ট খুঁজছিলাম। এমন সময় পারিবারিক কাজে চট্টগ্রাম যেতে হয়। চট্টগ্রাম যাবার পথে ট্রেনে বসে মোবাইলের বইয়ের কালেকশন ঘাঁটছিলাম। ঘাঁটতে গিয়ে ‘কনফেশন অব আ থাগ’ নামে একটা বই চোখে পড়ে। এর আগে ঠগীদেরকে নিয়ে কিছু তথ্য জানলেও ফিলিপ মিডোস টাইলারের এই বিখ্যাত বইটা পড়া হয়নি। আমি সাধারণত মোবাইল বা ল্যাপটপে বই পড়ি না। কিন্তু সেদিন আকর্ষণ থেকেই বইটা পড়তে শুরু করি। চট্টগ্রাম যাবার পথেই বইটা পড়তে পড়তে নিজের ভেতরে প্রচন্ড উত্তেজনা কাজ করতে থাকে। ঠগীদেরকে নিয়ে এর আগে কিছুটা জানলেও তাদের কর্মযজ্ঞ যে এতোটা ব্যাপক ছিলো সেটা জানতাম না আমি। বইটা পড়তে গিয়ে বার-বার মনে হচ্ছিলো পৃথিবীতে কতো ধরণের কাল্ট আছে, আর সেগুলো নিয়ে যদি ক্যাথরিন নেভিল, পল সাসম্যান, ড্যান ব্রাউন, জেমস রলিন্সরা দুর্দান্ত সব থৃলার লিখতে পারে তবে আমাদের ইতিহাসে এতো সমৃদ্ধ আর রহস্যময় অধ্যায় থাকতে আমরা কেন সেগুলো নিয়ে লিখবো না।

দ্য ডিসিভার্স সিনেমার একটি দৃশ্যে সাবেক জেমস বন্ড তারকা পিয়ার্স ব্রসনান ও শশী কাপুর। সিনেমাটি ১৯৮৮ সালে ইসমাইল-মার্চেন্ট প্রডাকশন থেকে নির্মিত হয়েছিল

চট্টগ্রাম থেকে ফিরেই শুরু হয় কনটেন্ট কালেকশন। ঠগীদের ওপরে যতো বই আর সিনেমা পাই সব সংগ্রহ করে পড়তে আর দেখতে শুরু করি। ইরেজির ভেতরে; ফিলিপ মিডোস টাইলারের লেখা ‘কনফেশন অব আ থাগ’, ‘বেগমস থাগস এন্ড রয়ালস’ (এই বইয়ের সঠিক নামটা আমার মনে নেই), ‘পেপারস অন থাগি কাল্ট’ (এটা নন ফিকশন), জন মাস্টার্সের লেখা ‘দ্য ডিসিভার্স’, ‘মডার্ন ইন্ডিয়া’, ‘দ্য ইয়েলো স্কার্ফ’। বাংলার ভেতরে শ্রীপান্থের ‘ঠগী’, ‘ফিরিঙ্গী ঠগী’, ‘মৃত্যুদূত’; মোদ্দা কথা যা পাই পড়তে থাকি। সেইসাথে চলতে থাকে সিনেমা দেখা। সাবেক জেমস বন্ড তারকা পিয়ার্স ব্রসন্যান অভিনীত ইসমাইল-মার্চেন্ট প্রডাকশনের ১৯৮৮ সালে নির্মিত সিনেমা ‘দ্য ডিসিভার্স’, ‘স্ট্যাঙ্গলার্স অব বোম্বে’, ক্যারি গ্রান্ট অভিনীত বিখ্যাত লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিং এর কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত সিনেমা ‘গুঙ্গা দীন’ থেকে শুরু করে একাধিক ডক্যুমেন্টারি; অর্থাৎ ঠগীদের ওপরে যা পাই গোগ্রাসে গিলতে থাকি বললে ভুল হবে না। আমার মনে পড়ে ২০১৬ সালের শেষ তিনটা মাস একরকম বলতে গেলে ‘ঠগী আক্রান্ত’ ছিলাম আমি।

শশীলজের বাইরের অংশ

সপ্তরিপুর প্রস্তুতিকালীন সময়টাতে দীর্ঘদিন পর নিজের শহর ময়মনসিংহে বেড়াতে যাই আমি। সেখানে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে মুক্তগাছা জমিদার বাড়ি, শশীলজে বেড়াতে গিয়ে আমার খালুর কাছে মুক্তাগাছা শহরের এক পুরনো সিন্দুকের ব্যাপারে জানতে পারি। যারা ‘সপ্তরিপু’ পড়েছেন তারা জানেন বইয়ের মাঝামাছি জায়গায় জয়া সরকারের জবানীতে মুক্তাগাছা শহরে যে-সিন্দুকের বর্ণনা দেয়া আছে সেটা সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা। একদিকে শশীলজ-মুক্তাগাছা জমিদার বাড়িতে বেড়ানো, সেইসাথে ছোটবেলা থেকে শুনে আসা ময়মনসিংহ শহরের নানা মিথ আর অন্যদিকে খালুর কাছে শোনা সিন্দুকের গল্প সব মিলিয়ে ঠিক করি কাহিনীর প্রেক্ষাপট সাজাবো নিজের শহর ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় ফিরে বিশদ আউটলাইনঙের কাজ করি প্রায় দুই মাস। সেটা শেষ হবার পর অবশেষে লিখতে শুরু করি ‘সপ্তরিপু’। এভাবেই সপ্তরিপুর জন্ম। সপ্তরিপুতে ময়মনসিংহ শহরের বর্ণনা আর নানা মিথের কম্বিনেশন কিছুটা পড়ে জেনেছি আর বাকিটা আমার নিজেই অভিজ্ঞতা আর বড় কাছ থেকে শোনা গল্প অবলম্বনে লেখা। এমনকি বইতে বর্ণিত বাশারের অনেক বন্ধু আর স্থানের বর্ণনা আসলে আমার নিজেরই বন্ধু-বান্ধব আর অভিজ্ঞতার বর্ণনা।

মুক্তগাছা জমিদার বাড়ির একাশং

সপ্তরিপু এবং সময় উপাখ্যান লেখার পেছনে আমার বেশ কিছু মোটো ছিল। এক, আমাদের দেশী মিথ লেজেন্ডগুলোর সাহিত্যের পাতায় এক রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার মাধ্যমে তুলে নিয়ে আসা। দুই, থ্রিলার গল্প এবং উপন্যাসের সেটিং শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক না রাখা, তাই একে সাজিয়েছিলাম ময়মনসিংহের প্রেক্ষাপটে, এরপর ব্ল্যাক বুদ্ধ সিলেটে এবং মগরাজ চট্টগ্রামে। তিন, থ্রিলার উপন্যাস বড় এবং ডার্ক থিম নিয়ে হতে পারে সেই ধারণার সৃষ্টি করা। আজ যখন পাঁচ বছর পর আমেরিকায় বসে সপ্তরিপুর গল্পের পেছনের গল্প লিখছি একই সাথে নস্টালজিয়া এবং প্রাপ্তির এক অদ্ভতু মেল বন্ধন অনুভূত হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ এবং কোলকাতায় সপ্তরিপু এবং সময় উপাখ্যানের ব্যাপক সাফল্য প্রমাণ করে আমার উদ্দেশ্যগুলোর ভেতরে অনেকগুলোই সফল।  সপ্তরিপু বাংলা থ্রিলারের জগতে অনেককিছুই বদলে দিতে পেরেছে। আর এই সফলতার মুকুটে সর্বশেষ পালক সপ্তরিপু নিয়ে এসভিএফ (শ্রী ভেঙ্কেটেশ ফিল্মসের চুক্তি সম্পন্ন হওয়া। যদি সব ঠিক থাকে তবে শিঘ্রেই সপ্তরিপু হইচই থেকে সিরিজ আকারে নির্মিত হতে যাচ্ছে।

শশীলজের পুকুর ঘাট, পুরো গল্পে এই জায়গাটার একটা বিরাট ভূমিকা আছে
আমার নানাবাড়ির বাইরের অংশ, জায়গাটা মুক্তাগাছা যাবার পথেই পড়ে, দুনিয়ার যেখানেই যাই চিরকাল আমার মনের গহীন কোনে এটাই আমার প্রিয় জায়গা হয়ে থাকবে

বই কেনার লিঙ্ক: Click Here

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

bn_BDBN