থ্রিলারের সংজ্ঞায়ন এবং সার্বিকতা
থ্রিলার এমন একটি শব্দ যা সাহিত্য, সিনেমা, টিভি অনুষ্ঠান, সঙ্গীত এমনকি কম্পিউটার গেমের ক্ষেত্রেও সমানভাবে জনপ্রিয় এবং পরিচিত। তবে সত্যিকার অর্থে থ্রিলার আসলে কি? বা কাকে আমরা থ্রিলার বলবো? আমেরিকার জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক জেমস প্যাটারসন থ্রিলার অ্যানথলজিতে থ্রিলারকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, যা পাঠককে থ্রিল করে তাই থ্রিলার, আর যদি সেটা না হয় তবে আমরা তাকে থ্রিলার বলতে পারিনা (থ্রিলার এনথোলজি, ২০০৬)। অ্যালফ্রেড হিচকক বলেছেন, থ্রিলার হল অনকটা ঠান্ডা পানির মতো, ঠান্ডা পানিতে পা ডোবালে মানুষ যেমন শিহরিত হয়ে উঠে তেমনি থ্রিলারও মানুষকে শিহরিত করে তোলে। মোট কথা থ্রিলার হল এমন একটি মাধ্যম যা মানুষকে একধরনের মানসিক উত্তেজনাময় উপলব্ধির মাধ্যমে আনন্দের স্বাদ পাইয়ে দেয়। সেক্ষেত্রে থ্রিলারের সার্বিক সংজ্ঞা অনুযায়ী এর মূল উপাদানগুলো হল তিনটি: ক্রাইম, কন্সপিরেসি এবং ইনভেস্টিগেশান। যেকোন মাধ্যম, সেটা সাহিত্য, সিনেমা আর টিভি সিরিয়াল হোক এই তিনটি মূল উপাদানের অন্তত দুটি উপস্থিত না থাকলে কিংবা একটির সার্বিক উপস্থিতি না থাকলে সেটাকে থ্রিলার বলা যায় না। প্রশ্ন হেল সার্বিক উপস্থিতি বলতে আসলে কী বোঝচ্ছে। মোদ্দা কথা হল, একটা ফিকশনের মূল গল্পটা যদি ক্রাইম কন্সপিরেসি কিংবা ইনভেস্টিগেশনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় তবে সেটাই থ্রিলার, তা যে সাবজনরার অন্তর্ভূক্তই হোক না কেন।
এখন আসা যাক থ্রিলারের শাখা প্রশাখা বা সাব-জনরা বিষয়ে। বর্তমান বিশ্ব থ্রিলারের জগৎ অনেক বিরাট এবং বিস্তৃত। ক্রাইম, কন্সপিরেসি এবং ইনভেস্টিগেশান এই তিনটি বেসিকের উপরে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে থ্রিলারের অসংখ্য প্রকারভেদ বা সাবজনরা। যার মধ্যে অন্যতম কয়েকটা হল মার্ডার মিস্ট্রি, লিগ্যাল থ্রিলার, স্পাই থ্রিলার, সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার, অ্যাকশান-অ্যাডভেঞ্চার থ্রিলার, মেডিকেল থ্রিলার, পলিটিক্যাল থ্রিলার, রোমান্টিক থ্রিলার, হিস্টোরিক্যাল থৃলার, হাইটেক থৃলার, মিলিটারি থ্রিলার ইত্যাদি। মজার বিষয় হল এসব সাবজনরার সমন্বয়ে আবার প্রতিনিয়ত তৈরী হচ্ছে নতুন ক্যাটাগরির থ্রিলার। যেমন পলিটিক্যাল মার্ডার মিস্ট্রি, রিলিজিয়াস মিথোলজিক্যাল থ্রিলার, সাইবার পাঙ্ক কিংবা বায়ো পাঙ্ক এন্ড হাইটেক থ্রিলার, করপোরেট কন্সপিরেসি থ্রিলার ইত্যাদি। আবার থ্রিলারের নতুন নতুন ক্যাটাগরিও যে তৈরী হচ্ছে না তাও নয়। যেমন ক্যাথরিন নেভিলের দ্য এইট ছিল নতুন ধরনের কাল্ট থ্রিলার, রবিন কুকের হাত ধরে আসে মেডিকেল থ্রিলার কোমা, এখনকার সময়ে সায়েন্স ফিকশান থ্রিলার পুরো পৃথিবীব্যাপী দারুন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
সত্যিকার অর্থে বর্তমান বিশ্বে থ্রিলারের জগৎ এতোটাই বিস্তৃত যে ওয়ার্ল্ড বুক মার্কেটের একটা বড় অংশ থ্রিলারের দখলে। এমনকি বিশ্ব সিনেমা এবং টিভি সিরিজের একটা বড় অংশ নির্মিত হয় জনপ্রিয় থ্রিলার উপন্যাস অবলম্বনে। এরই ভিত্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের থ্রিলার লেখকেরা মিলে গড়ে তুলেছেন বিশ্বব্যাপী থ্রিলারের সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনার থ্রিলার রাইটারস’ যাকে সংক্ষেপে ডাকা হয় আইটিডব্লিউ। এই সংগঠন গড়ে উঠার ইতিহাসটাও বেশ মজার।
থ্রিলারের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র আমেরিকা এবং আমেরিকান থ্রিলার রাইটারেরা বহু বছর ধরেই চিন্তা করছিলেন একসাথে হবার। কিন্তু সেটা হয়ে উঠেনি। ২০০৪ সালে অ্যারিজোনার পয়জন পেন বুক স্টোরের স্বত্বাধিকারী বারবারা পিটার ছয়জন থ্রিলার লেখককে নিয়ে একটা মিটিং করেন। যার ভেতরে ছিলেন লি চাইল্ড, ভিন্স ফ্লিন, স্টিভ হ্যামিলটন, গায়েল লিন্ডস, ডেভিড মোরেল এবং ক্যাথি রাইখ আর সেন্ট মার্টিন প্রেসের এডিটর কিথ কাহলা। তারা সবাই মিলে একটা কনফারেন্সের আয়োজন করার জন্যে বিভিন্ন থ্রিলার লেখকদের কাছে প্রেজেন্টেশান পেপার আহ্বান করেন। প্রাথমিকভাবে জমা পড়ে ১২৫টা পেপার। সফলভাবে কনফারেন্স শেষ করার পর তারা চিন্তা করেন এর ক্ষেত্রটা আরো বাড়ানো উচিত। তখন সমস্ত বিশ্বের থ্রিলার রাইটারদের কাছে বই এবং মেম্বারশিপ আহ্বান করা হয়। পুরো ব্যাপারটার দায়িত্ব দেয়া হয় গায়েল লিন্ডসকে। কিন্তু এই বিশাল দায়িত্বের বোঝা একা সামলানোর অপারগতা প্রকাশ করে সম্মানের সাথে উনি সেটা তুলে দেন ডেভিড মোরেলের হাতে।
এবার সাড়া পাওয়া যায় অস্বাভাবিক। অবশেষে চারশো স্থায়ী মেম্বার আর অসংখ্য সাধারই মেম্বারের সমন্বয়ে ২০০৪ সালের নভেম্বরে গড়ে উঠে বিশ্বের সবচেয় বড় থ্রিলার সংগঠন আইটিডব্লিউ। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা প্রায় লাখের কাছাকাছি এবং তাদের মৌলিক থ্রিলার বইয়ের সংখ্যা মিলিয়নের উপরে এবং আইটিডব্লিউ এর হিসাব অনুযায়ী শুধুমাত্র তাদের মেম্বারদের থ্রিলার বই প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ব্রিক্রী হয় ষোল কোটি কপির উপর (এটা ২০১৩ সালের বয়ান। বর্তমানে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি)।
বর্তমান বিশ্বের থ্রিলার পরিস্থিতির পর আমাদের দেশের থ্রিলার পরিস্থিতি নিয়ে বলতে গেলে, আমাদের দেশের পাঠকদের কাছে থ্রিলারের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে তরুন থ্রিলার বই বর্তমান সময়ের ক্রেজ। বিশ্বমানের থ্রিলারগুলোর অনুবাদ পড়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের পটভূমিতে লেখা মৌলিক থ্রিলারের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। যার ছোঁয়া এমনকি আমরা টের পাচ্ছি আমাদের সিনেমা জগৎ এবং টিভি মিডিয়াতেও। বাংলাদেশের তরুন নির্মাতাদের জন্যে বিশ্বমানের থ্রিলার নির্মান করা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
যেকোন সাহিত্যে যখন সাহিত্যের কোন একটি জনরা বা সাব-জনরা জনিপ্রিয়তা পায় সেটা সার্বিকভাবে সাহিত্যের জন্যে মঙ্গলই বয়ে আনে। বিশ্ব সাহিত্যের যুগ বিভাজনের দিকে তাকালেও এটা অনুধাবন করা যায় পরিষ্কার। কাজেই বর্তমান সময়ে বাংলা সাহিত্যে থ্রিলার, ফ্যান্টাসি, সাকোলজিক্যাল ফিকশন ইত্যাদির জনপ্রিয়তা সমানতালে এগিয়ে চলুক।
– রবিন জামান খান
শিক্ষক, সাহিত্যিক ও গবেষক
ওকলাহোমা, যুক্তরাষ্ট্র